“একজন গৃহিণীর উদ্যোক্তা হয়ে উঠার গল্প “
“আফরোজা হাসান পারুল “একজন উচ্চশিক্ষিত আটপৌরে গৃহিণী। বাঙ্গালী আর আটদশ জন গৃহিণীর মতই সন্তান সংসার নিয়ে চলছিলো উনার জীবন । কিন্তুু মহামারি করোনায় যেন সব বদলে গেলো। থমকে গেলো সবকিছু, নেই কোন ব্যস্ততা, নেই কোথাও যাওয়ার সুযোগ। ঘরে বসে বসে বেশিরভাগ মানুষই অলস সময় কাটাচ্ছিল পারুল তখন এগিয়ে যান তার স্বপ্নের পথে। হয়ে উঠেন একজন সফল উদ্যােক্তা। জন্ম নেয় AMP Passon MODE এর। চলুন শুনি উনার গল্প।
ক্যারিয়ারের শুরুতে আফরোজা হাসান পারুল, বাংলায় অনার্স মাস্টার্স শেষ করে নিবন্ধন করে একটা কলেজে ছিলেন বেশ কিছু দিন। কিন্তু মেয়েটা তখন ছোট, অসুস্থ থাকত প্রায়ই। প্রতি মাসে ওকে একা কাজের লোকের উপর দিয়ে বাইরে বের হওয়াটা উনার জন্য সহজ ছিলনা। তাই বিনা দ্বিধায় ছেড়ে দিলেন শিক্ষকতা। এদিকে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের পরিচিত মুখ ছিলেন তিনি। টিভি, মঞ্চ, দেশে এবং দেশের বাইরে প্রচুর পুরষ্কার জয় করেছেন। স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি সব জায়গা সমান তালে জয় করছেন। টিভিতে নিউজ প্রেজেন্টার হিসেবে কাজ করেছেন কিছুদিন। কিন্তু সব কিছু, সব প্রতিভা কে বাক্স বন্দী করতে হয়েছিল সংসার আর সন্তানের জন্য। ঢাকায় বসবাসকারী একক পরিবারের মানুষেরা জানে যে, কাজের লোক পাওয়া কতটুকু ঝামেলা আর তার চাইতে তাদের কাছে বাচ্চা রেখে যাওয়া ছিলো আরও বড় ঝামেলার। হিসেব করলে জীবনে ত্যাগের খাতাটা নেহায়েতই কম ছিল না পারুলের। সন্তানের কথা ভেবে ভেবে এক সময় ভুলেই গিয়েছিলেন তার অনেক প্রতিভা ছিল, ছিলো অনেক সার্টিফিকেট। চাইলে যেতে পারতেন অনেক দূর। অনেকেই হয়তো তারপরও কাজ করেন, অনেক সমস্যা কে জয় করেই করেন। কিন্তু পারুলের একটা নিজস্ব চিন্তা ছিল যে, আমার বাচ্চাটাকে আমি কাজের লোকের উপর রেখে গেলে সে কি শিখবে? সব শেষে নিজের গোল যদি শূন্য হয়ে যায়? বাচ্চা সঠিক শিক্ষা নিয়ে যদি না বড় হয়, তাহলে কি হবে আমার নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে? এত ভাবনার আরও একটা বড় বিষয় ছিল যে, উনার মেয়েটা প্রায় প্রতি মাসেই অসুস্থ থাকত, হাসপাতালে থাকতে হত। তাই সবকিছু বাদ দিয়ে শুধু সংসার আর সন্তানদের নিয়েই ছিলো উনার আটপৌরে জীবন। কিন্তু, মেয়েরা এখন বড় হয়েছে। উনার মেয়েরা মাকে আর এভাবে দেখতে চায়না, ওরা এ বয়সেই অনেক কিছু জানতে পেরেছে মায়ের ত্যাগের বিষয়ে, আর তাইতো ওরাই এখন মায়ের শক্তি আর সাহস হয়ে মায়ের নিজস্ব একটা পরিচয় বানাতে উঠে পরে লেগেছে। মাকে নিয়ে মেয়ের গর্বের শেষ নেই। তার মা পারবে, যা চায় তা-ই হতে পারবে। মুলত উনার ১৪ বছর বয়সী মেয়ের কনফিডেন্স থেকেই আবার স্বপ্নের পথে উনার যাত্রার শুরু। সাথে ছিলো উনার হাজব্যান্ড এর পুরোপুরি সাপোর্ট আর সহযোগীতা।
৯-১০-২০২০ তারিখে পারুল একটি বিজনেস পেইজ চালু করেন তার ভালো লাগা আর ভালবাসার জামদানী শাড়ি আর হ্যান্ডপেইন্টেড শাড়ি নিয়ে। ৮/৯ মাসের যাত্রায় তিনি এখন নিজেকে একজন উদ্যোক্তা বলে পরিচয় দিতে পারেন। সফল উদ্যোক্তা এখনো অনেক সময়ের ব্যাপার, তবে তিনি মনে করেন ইনশাআল্লাহ একদিন লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবেন। কারন মসলিন কাপড়ে অথবা সুতি বা যে কোন মোটিফে নিখুঁত ভাবে আঁকার কাজ করা হয়, এ কাজের জন্য উনার একটা স্ট্রং টিম আছে যারা কিনা চারুকলায় পড়া স্টুডেন্ট। তাই কাজের গুণগত মান হয় বিশ্ব বাজারের সাথে প্রতিযোগিতা করার মতো। এছাড়া ঢাকাইয়া জামদানি তৈরি করার জন্য উনার নিজস্ব তাঁতি আছেন, যাঁরা নিজেদের করা ডিজাইন ছাড়াও কাস্টমারদের পছন্দ অনুযায়ী জামদানী শাড়ি এবং পাঞ্জাবি তৈরি করে দেন। উনার কাছে উনার কাজ সম্পর্কে জানতে চাইলে উনি একটি কথা দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন যে “আমার মূল কথা হচ্ছে, সবচেয়ে ভালো মানের পণ্য টি গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেওয়া”। সেজন্য দিনদিন কাস্টমার সন্তুষ্টি অর্জন করতে পেরেছি আলহামদুলিল্লাহ। তিনি আরো জানান, আমার কাজের প্রতি আস্থা এবং বিশ্বাস বাড়ছে পরিচিত এবং অপরিচিতদের। এটা আমার পরম পাওয়া। শুরু থেকে আমাকে সাপোর্ট করছে আমার স্কুল বন্ধুরা, পরিচিতরা। এখন আমি স্বপ্ন দেখি আমার AMP Passion MODE একদিন বাংলাদেশের নামকরা ব্র্যান্ড হিসেবে জায়গা করে নিতে পারবে। আমাদের কাজ দেশ ছেড়ে দেশের বাইরেও তার নিজস্বতা তুলে ধরতে পেরেছে। আমার উদ্যোগের শাড়ি আমেরিকাতে দুইবার গিয়েছে আলহামদুলিল্লাহ। আরও অনেক দেশেই হয়তো যাবে। পোশাকের পাশাপাশি লেদার আইটেম নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা আছে, ইতোমধ্যে লেদার বেল্ট নিয়ে কাজ করেছি। এরপর সামনে আসবে, লেদার ব্যাগ, জুতা, লেদার জ্যাকেট। আমি বিশ্বাস করি, কাজে যদি শতভাগ অনেস্ট থাকা যায় তাহলে তার জায়গা পাকাপোক্ত হতে বাধ্য। সততার সঙ্গে কাজ করে এগিয়ে যেতে চাই। লাভের আশায় বিজনেস করার চাইতে সম্পর্কের জোর বাড়াতে আমার এই বিজনেস, এটাই আমার মনের ইচ্ছা। আমি মনে করি রিপিট কাস্টমার তৈরি হলেই আমি সফল হবো। কারন যিনি ক্রেতা হবেন, তিনি বাজার যাচাই করে দেখবেন যে AMP থেকে পন্য কিনে তিনি ঠকেননি। তার আস্থার জায়গা হবে শক্ত। এটাই আমার বিজনেসের মূলমন্ত্র। আমি অনেক পথ পারি দিয়ে উদ্যোক্তার খাতায় নাম লেখালাম। একদিন হয়তো সফলতা আসবে ইনশাল্লাহ।”
আফরোজা হাসান পারুলের জয়ের গল্পে আমরা উনার সাথে আছি, ভবিষ্যৎ ও থাকবো। আমাদের শুভকামনা রইল আপনি সহ আপনার মত স্বপ্নবাজ নারীদের জন্য যারা কিনা হাজারো নারীর বাতিঘর হিসেবে কাজ করবেন। সু্ন্দর হবে আমাদের পৃথিবী।
লেখক:ফারহানা ববি,উদ্যোক্তা বিষয়ক সম্পাদক,দৈনিক প্রত্যয়
উদ্যোক্তার ফেসবুক পেইজ লিংক: https://www.facebook.com/amppassionmode/