১৯৪৭-এর দেশভাগে জন্ম নিয়েছে দুটি দেশ। সীমান্তে পড়েছে কাঁটাতারের বেড়া। তবে বিভাজনের এই রেখা ভাগ করতে পারেনি সাতক্ষীরা সদরের ডোমার সীমান্তবর্তী ৭০টি পরিবারকে। বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তবর্তী দুটি গ্রামে ২২টি বাংলাদেশি আর ৪৮টি ভারতীয় পরিবারের সৌহার্দ্যপূর্ণ বসবাস সুদীর্ঘকাল ধরে। তাদের মধ্যে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার কথা শোনা যায়নি কখনও। এলাকাটি বাংলাদেশে হাড়দ্দহ আর ভারতে পানিতর নামে পরিচিত।
শুধু সৌহার্দ্যপূর্ণ সহাবস্থানই নয়, বিপদ-আপদেও সবসময় পরস্পরের পাশে থাকেন তারা।
হাড়দ্দহ গ্রামের (১ নম্বর সীমানা পিলার সংলগ্ন) ২২টি পরিবারে বাসিন্দার সংখ্যা ৭০ জন। আর ভারতের বশিরহাট থানার পানিতর গ্রামের ৪৮টি পরিবারে রয়েছেন ১৫০ জন মানুষ। এই সীমান্ত এলাকা দিয়ে বয়ে যাওয়া ইছামতী নদীর তীরে এলাকাটির অবস্থান।
সেখানকার বাংলাদেশি নাগরিক শওকত আলী গাজী। বংশপরম্পরায় তাদের বসবাস এখানে।
তিনি বলেন, ‘আমার দাদা-বাবা এখানে বসবাস করতেন। তাদের সূত্রে আমিও এখানেই থাকছি। ঠিক কত বছর ধরে আমাদের পরিবার এই এলাকায় বসবাস করে আসছে তার কোনো সঠিক হিসেব জানা নেই।’
শওকত আলীর ভাষায়, ‘এখানে ভারত ও বাংলাদেশের মানুষদের মাঝে আন্তরিক সম্পর্ক বিরাজমান। একজনের বিপদে আরেকজন ছুটে আসে। কখনও বিবাদ হয়নি। ছেলে-মেয়েরাও একত্রে খেলাধুলা করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘চিকিৎসকের প্রয়োজন পড়লে উভয় দেশের যেকোনো চিকিৎসক চলে আসেন। আমাদের এখানে সীমান্তরেখা এমন যে থাকার ঘরটি বাংলাদেশে, আবার হয়ত রান্নাঘরটি ভারতে। সামনেই বিজিবি ও ওপারে বিএসএফের টহল রয়েছে। দুই দেশের নাগরিকরা একত্রে বসবাস করলেও সীমান্তরক্ষীদের অতিক্রম করতে পারেন না। তারা বাধা দেন।’
তার স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, ‘আম্ফানের সময় আমার ঘরটি ভেঙে গিয়েছিল। নদীর পানিতে বাচ্চাদের বইখাতাসহ সবকিছু নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তবে সরকারি কোনো সহযোগিতা পাইনি। ভারতীয়রা করোনার সময়ে রেশন চাল, ডাল, তেল, আটা পায়। আমরা কিছু পাইনি।’
ভারতীয় পানিতর গ্রামের বাসিন্দা দাউদ আলী গাজী বলেন, ‘সীমান্তে একত্রে বসবাস। তবে আমরা বাংলাদেশের মধ্যে যাই না। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য পার্শ্ববর্তী ইন্ডিয়া বাজারে যেতে হয়। তাছাড়া বড় কোনো প্রয়োজনে যেতে হয় বশিরহাট বা কলকাতায়। বসবাসের এই জায়গাটুকু ছাড়া বাংলাদেশের ভেতরে যেতে দেয় না বিজিবি। তবে পোষা প্রাণীগুলোকে তো আর আটকে রাখা যায় না।’
তিনি আরও বলেন, ‘করোনার সময়ে ভারত সরকার আমাদেরকে ফ্রি রেশন দিচ্ছে। সেটি খেয়ে বেঁচে আছি। আমাদের কোনো অসুবিধা নেই।’
ভারতীয় নাগরিক মঞ্জুয়ারা বেগম বলেন, ‘সীমান্তরেখা দুইদেশকে ভাগ করলেও এখানকার মানুষকে ভাগ করতে পারেনি। প্রয়োজনে আমরা তাদের বাড়িতে যাই, তাদের প্রয়োজন হলে তারা আমাদের বাড়িতে আসে।’
স্থানীয় ভোমরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইসরাইল গাজী জানান, ‘হাড়দ্দহ ও পানিতর গ্রামের পরিবারগুলো শান্তিপূর্ণভাবে পরিবেশে বসবাস করছে। তাদের মাঝে কখনো বিবাদ হয়েছে বলে আমার জানা নেই। করোনার সময় ওই এলাকায় বসবাসকারী বাংলাদেশি নাগরিকদের সরকারি সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়েছে। অনেকের অনেক রকম দাবি থাকে, সব পূরণ করা সম্ভব হয় না।’
এ বিষয়ে সাতক্ষীরা ৩৩ বিজিবির সদ্য বিদায়ী অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল গোলাম মহিউদ্দীন খন্দকার বলেন, সীমান্তের ১ নম্বর পিলারের ওখানে জায়গাটিই এমন যে, দুই দেশের নাগরিকদের ঘরবাড়ি পাশাপাশি। তবে সীমান্তে বিজিবির সার্বক্ষণিক টহল রয়েছে। ভারতীয় নাগরিকদের বাংলাদেশে প্রবেশের সুযোগ নেই।’