উপমন্যু রায়
বাংলায় একটা কথা আছে, ‘অতি চালাকের গলায় দড়ি।’
জানি না চিনে এমন প্রবাদ প্রচলিত আছে কিনা, কিংবা বিষয়টা তারা জানে কিনা। তবে চিনা ভাষা এবং সংস্কৃতিও তো অনেক সমৃদ্ধ। সেখানেও নিশ্চয় পুরোপুরি না হলেও এমন ধরনের বাক্য থাকতেই পারে। তবে, এ কথা বিনাদ্বিধায় বলতে পারি, চিনের সরকার সেই কথা হয় জানে না, কিংবা স্বীকার করে না। আর, সেটা তারা করে আসছে ১৯৪৯ সাল থেকেই। এখন বিষয়টা ধরা পড়ে যাচ্ছে।
চিনের শি জিনপিং সরকার নিজেদের খুব বুদ্ধিমান মনে করছে। করতেই পারে। সেটা তাদের নিজেদের ব্যাপার। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। কারণ, ওই ভাবনার পাশাপাশি তাদের হয়তো ধারণা, অবশিষ্ট পৃথিবী মূর্খ। তাই তারা গোটা দুনিয়াকে যা বোঝাবে, সকলেই তা এক বাক্যে মেনে নেবেন। তারা যা বলছে, তা ঠিক কিনা, সে–সব কিছুই কেউ যাচাই করে দেখবেন না।
বলা বাহুল্য, বোকা বোকা শোনালেও বর্তমান আন্তজার্তিক ক্ষেত্রে চিনের তথাকথিত কমিউনিস্ট সরকার সেই মনোভাবই পোষণ করছে। আর, সেই অনুযায়ীই কাজ করে চলেছে।
ব্যাপারটা একটু পরিষ্কার করে বলা যাক। ভারত ও চিনের সম্পর্কে তিক্ততা যখন চরম পর্যায়ে পৌঁছে যেতে বসেছে, তখন চিনের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র হুয়া চুনিং দাবি করেছেন, নতুন চিন প্রতিষ্ঠার ৭০ বছরের মধ্যে কোনও বিদেশি অঞ্চলের এক ইঞ্চি জমিও দখল করেননি তাঁরা। তাঁর আরও দাবি, নতুন চিন প্রতিষ্ঠার সত্তর বছরে চিন কখনও কোনও যুদ্ধ বা সঙ্ঘাতকে উসকে দেয়নি। চিন সবসময় এলএসি কঠোর ভাবে মেনে এসেছে। কখনও নিয়ন্ত্রণ রেখা অতিক্রম করেনি।
চিনের এমন কথায় হাসব, না কাঁদব, বুঝতে পারছি না। শুধু তো ভারতই নয়, চিন যদি এত মহান দেশই হয়, তা হলে তাদের সঙ্গে প্রায় সব প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে কেন এত সমস্যা? ভারতের কথা না হয় বাদই দেওয়া গেল, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মঙ্গোলিয়া, রাশিয়া, তাইওয়ান, ভিয়েতনাম, ফিলিপিনস, মায়ানমার, ভুটান —সব দেশই তো তাদের আগ্রাসন নিয়ে সোচ্চার। তিব্বতকে তো ১৯৫০ সাল থেকে জোর করে দখল করে রেখেছে। এখন হংকং নিয়ে একই পথ অনুসরণ করতে চলেছে।
ভুটানের কাছেও বড় বিপদ এখন এই চিনই। ভুটানের জমিকে চিন ইতিমধ্যে নিজেদের জমি বলে দাবি করতে শুরু করেছে। ভুটানের মধ্য ও পশ্চিম সেক্টরে সেই জমিতে চিন রাস্তা ও হেলিপ্যাড তৈরি করছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। ডোকলাম মালভূমির কিছু অংশও এর মধ্যে রয়েছে।
ভুটানের পূর্বদিকের সাকতেং অভয়ারণ্যের মালিকানা তাদেরই বলে আগেই দাবি করেছিল তারা। ভারত–সহ কয়েকটি দেশ ভুটানের পাশে দাঁড়ানোয় চিনের সেই উদ্দেশ্য সফল হয়নি। ফের গুটিগুটি পায়ে সেই দাবির দিকেই এগোতে শুরু করেছে তারা।
এর পরও চিন কী করে যে নিজেদের এত মহান ভাবে, মাথার চুল ছিঁড়লেও তা কেউই ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারবেন না। আর ভারতের কথাই যদি ধরি, ১৯৬২ সালে আকসাই চিনের ৩৭ হাজার ২৪৪ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল দখল করে তারা।
২০০৮ সালেও ভারতীয় সীমায় চবি এবং প্যাংনাক উপত্যকার ২৫০ কিমি ভেতরে ঢুকে আসে। ২০১২ সালে জোরাওয়ার ফোর্ট ধ্বংস করে অবজার্ভিং পয়েন্ট বানিয়েছে। এখানেই শেষ নয়, অরুণাচল প্রদেশ, সিকিম এবং লাদাখ চাইছে তারা।
এ–সব ক্ষেত্রে চিন অদ্ভুত একটি মধ্যযুগীয় যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করে চলেছে। তা হল ‘ঐতিহাসিক’ দিক থেকে সেইসব অঞ্চল নাকি চিনেরই। কোন যুগে কোন অঞ্চলে চিনের কোন রাজার প্রভাব ছিল, সেই যুক্তি উল্লেখ করে সেইসব অঞ্চল তাদের বলে মাও সে তুংয়ের সময় থেকেই সে দেশের কমিউনিস্ট সরকার দাবি করে চলেছে। চিনের ধারণা, এই দাবি মেনে সব অঞ্চলই নিজেদের স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়ে তাদের আধিপত্য মেনে নেবে।
কিন্তু, বাস্তব ক্ষেত্রে তা হচ্ছে না বলেই গায়ের জোর দেখাতে চাইছে তারা। তাই কয়েকদিন আগেই ভারতকে সতর্ক করতে গিয়ে এমন হুমকিও চিন দিয়েছে, এক ইঞ্চি জমি তারা কাউকে ছেড়ে দেবে না।
কিন্তু এই মুহূর্তে যে আয়তন তাদের রয়েছে, ভবিষ্যতে সেই আয়তন আদৌ তারা ধরে রাখতে পারবে কিনা, সে কথা চিন একবারও ভেবে দেখছে না। তাদের মনে রাখা উচিত, তিব্বত নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে কিন্তু ইতিমধ্যে কথা উঠতে শুরু করে দিয়েছে।
গালোয়ান নিয়েই একটা ছোট উদাহরণ দেওয়া যাক। সম্প্রতি গালোয়ান উপত্যকায় এবার ভারত ও চিনের মধ্যে সঙ্ঘর্ষের কথা এই মুহূর্তে গোটা পৃথিবীই জেনে গিয়েছে।
এই উপত্যকায় চিন আচমকা হামলা চালালে ২০ জন ভারতীয় সেনা প্রাণ হারান। তবে কতজন চিনা সেনার মৃত্যু হয়েছে, তা নিয়ে নীরব রয়েছে জিনপিং সরকার। মার্কিন সংবাদপত্র ‘নিউজ উইক’ জানিয়েছে, ওই সঙ্ঘর্ষে চিনের ৬০ জন সেনা নিহত হয়েছেন।
এখন চিন বারবার বোঝানোর চেষ্টা করছে গালোয়ান নাকি তাদেরই। ভারত নাকি তা দখল করে রেখেছে!
ব্যাপারটা নিয়ে একটা সত্য কাহিনিই বলছি।
লাদাখে কয়েক পুরুষের বাসিন্দা গালোয়ান পরিবার। এই পরিবারই গালোয়ান উপত্যকার আবিষ্কর্তা। সেই পরিবারের বর্তমান সদস্যদের একজন হলেন মহম্মদ আমিন গালওয়ান। তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, ওই ভূখণ্ডে চিনের কোনও অধিকার বা দাবি থাকতেই পারে না। গোটা গালোয়ান ভূখণ্ড আর গালোয়ান নদী আবিষ্কার করেছিলেন তাঁরই দাদু গুলাম রসুল গালওয়ান।
গুলাম রসুলের জন্ম ১৮৭৮ সালে। মাত্র ১২ বছর বয়স থেকেই তিনি গালোয়ানের দুর্গম পার্বত্য এলাকায় গাইডের কাজ করতেন। কারাকোরাম, তিব্বত এবং মধ্য এশিয়ার পার্বত্য অঞ্চলে ব্রিটিশদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ করতে হত তাঁকে।
ব্রিটিশরা তখন রাশিয়া নিয়ে চিন্তিত ছিল। তিব্বতের পরই বিশাল রাশিয়া। ব্রিটিশদের আশঙ্কা ছিল, তিব্বত দখল করে নিলে সাম্রাজ্য বিস্তার করে রাশিয়া ঢুকে পড়তে পারে ভারতীয় উপত্যকায়। সেই কারণে সমস্ত তথ্য, খবরাখবর সংগ্রহ করতে লর্ড ডানমোরের নেতৃত্বে কয়েকজন ব্রিটিশ লাদাখের পথ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন।
তুষারঝড়ে পথ হারান সেই ব্রিটিশ দলটি। ত্রাতা হয়ে আসেন সেই গালওয়ান। পথ খুঁজতে গিয়ে এই উপত্যকার সন্ধান পান। সোজা কথায়, এই উপত্যকা তখনই প্রথম আবিষ্কৃত হয় বলা যায়।
এর আগে এই উপত্যকার কথা কারাই বা জানত? যাই হোক, গুলাম রসুল গালওয়ান তখন দেখতে পান নদীটিও। তাই সেই যাত্রায় প্রাণে বেঁচে ফিরে আসতে পেরেছিলেন ডানমোররা। গালওয়ানকে সম্মান জানাতে তাঁর নামেই তখন রাখা হয় উপত্যকার নাম।
গুলাম রসুলের নাতি মহম্মদ আমিন স্পষ্ট বলেছেন, ‘১৯৬২ সালেও এই এলাকা নিজেদের বলে চালাতে চেয়েছিল চিন। কিন্তু পারেনি। এই উপত্যকা ভারতের ছিল, আছে এবং থাকবেও। আমাদের সেনা যুদ্ধ করে গালোয়ান উপত্যকা থেকে চিনাদের হঠিয়ে দিয়েছে। তাঁদের কুর্নিশ।’
এবার আসি অন্য দেশগুলিকে বিব্রত করতে চিন কী কী পথ অনুসরণ করে, সে বিষয়ে। শুধু সরাসরি অন্য দেশগুলিকে হুমকি দেওয়াই নয়, আড়াল থেকে সন্ত্রাসবাদকে মদত দেওয়ার কাজটাও যে তারা করে থাকে, তার প্রমাণ তো মায়নমারই। তারা বারবারই অভিযোগ করে চলেছে, মায়ানমারের ভেতরে রাষ্ট্রবিরোধী শক্তিকে ক্রমাগত মদত দিয়ে চলেছে চিন।
এবার ভারতেও সেই অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে। ১১ সেপ্টেম্বর রাতে কাশ্মীরের বারামুল্লার ডাঙ্গেরপোরা এলাকায় তল্লাশি চালিয়ে পাকিস্তানের মদতপুষ্ট ৩ সন্ত্রাসবাদীকে ধরেছে ভারতীয় সেনা। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে প্রচুর চিনা অস্ত্র সামগ্রী। এর পরই অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে, চিন সেইসব অস্ত্র পাকিস্তান মারফত সন্ত্রাসবাদীদের হাতে পৌঁছে দিয়েছে।
এ ছাড়া, চিনের কথা ও কাজের মধ্যে যে তফাত বারবার দেখা যাচ্ছে, তাতে তাদের উদ্দেশ্য কিন্তু কারও কাছেই অপরিষ্কার থাকছে না। কিছুদিন আগে একটি অনুষ্ঠানে ভারতে নিযুক্ত চিনের রাষ্ট্রদূত সুন ওয়েডং দাবি করেছেন, ‘ভারত ও চিন বরাবরই বন্ধু দেশ। এ ক্ষেত্রে বিশাল ঐতিহ্য রয়েছে। এই বন্ধন অটুট থাকবে।’
আবার এই রাষ্ট্রদূতই ভারতে চিনা দূতাবাসের সাইটে অভিযোগ করেছেন, ‘ভারত ও চিনের সীমান্ত সমস্যা তৈরি করেছে ভারতই। গালোয়ানে ভারতই হামলা চালিয়েছে।’ এখানেই থেমে যাননি তিনি। একবার সংবাদ মাধ্যমের কাছে তিনি দাবি করেছিলেন, গালোয়ান নাকি চিনেরই অংশ। ভারতের উচিত তা মেনে নেওয়া।
এর পর চিনের অবস্থানটা কি আর ধোঁয়াটে থাকে? বলা বাহুল্য, না।
আসলে চিন এখন অদ্ভুত খেলা খেলছে। একদিকে, প্রকাশ্যে বন্ধুত্বের বার্তা দিচ্ছে। আর হিমালয় উপত্যকায় দুরভিসন্ধিমূলক কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ, এক হাতে দুই দর নিয়ে চলেছে তারা।
কিন্তু তারা বুঝতে পারছে না, এই উন্নত প্রযুক্তির যুগে তাদের সেইসব কাজ কারও কাছে গোপন থাকছে না। পরিণতি বুমেরাং হলে তাদের বিপদ যে কী হতে পারে, তা তারা হয় বুঝতে পারছে না, নয় বুঝতে চাইছে না।
এরই মাঝে গ্লোবাল টাইমস–সহ নিজেদের কিছু সংবাদ মাধ্যমের মুখ দিয়ে কখনও হুমকি দিয়ে যাচ্ছে, কখনও মিথ্যে সংবাদ ছাপছে বা পরিবেশন করে চলেছে, যা কমিউনিস্টরা চিরকালই করে থাকে।
এখানেই শেষ নয়, ভারতের ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (আইবি) একটি রিপোর্ট দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে। আগামী অক্টোবরের মাঝামাঝি পাকিস্তানের সঙ্গে মিলে যৌথ ভাবে কাশ্মীর উপত্যকায় হামলা চালানোর পরিকল্পনা করেছে চিন। তাদের উদ্দেশ্য, জম্মু–কাশ্মীর ও লাদাখকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করা। তার পর কাশ্মীর নাকি পাকিস্তানের হাতে তুলে দেবে আর লাদাখ তারা নেবে।
কী বলব একে? —‘মামার বাড়ির আবদার’ আর কী!
পাকিস্তান তাদের হয়তো বিশ্বাস করতে পারে, (এখন তো গোটা দুনিয়ায় পাকিস্তান আর নেপাল ছাড়া তাদের কথা কেউ শুনছে না, তাও ওই দুটি দেশের ভেতরে আবার চিন নিয়ে যথেষ্ট বিরূপ কথাও শোনা যাচ্ছে,) কিন্তু বাকি পৃথিবী কিন্তু তাদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
শ্রীলঙ্কায় বেশ কিছু বছর ধরে ভারত–বিরোধী মনোভাব তৈরি করার চেষ্টা চালিয়েছে তারা। লাভ যে বিশেষ কিছুই হয়নি, তা শ্রীলঙ্কার শীতল আচরণেই পরিষ্কার। বাংলাদেশের সঙ্গেও বেশ কয়েক বছর ধরে একই চেষ্টা করেছে চিন। করোনা–সময়ে তো ঝাঁপিয়েই পড়েছিল।
কিন্তু, কথা হল, চিনের বন্ধুত্ব স্বীকার করেও বাংলাদেশ সরকার ভারতের সঙ্গে বৈঠকে বসতে দ্বিধা করেনি। বরং বুঝিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশ সকলেরই বন্ধু হতে আগ্রহী, কিন্তু একজনের বন্ধু হওয়ার জন্য অন্যজনকে শত্রু ভাবতে পারবে না।
অতি বুদ্ধিমান চিন কী ভাবছে এর পর? কল্পনার জগতে বিচরণ করে মাও সে তুং চিনের যে ভবিষ্যৎ–সীমানা এঁকেছিলেন, সেই আদিম ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে বাস্তবটা বোঝার চেষ্টা না করলে তারাই বিপদে পড়তে পারে। তাদের মানচিত্রের ভারটাও কিন্তু কম নয়! সেই ভার তাদের টলিয়ে দিতেই পারে।
নিজের দেশের সাধারণ মানুষের মনের খবর কতখানি নিয়েছেন তারা? চিরকাল গায়ের জোরে সব কিছু করা যায় না। এক সময় দুই মেরু বিশ্বের অন্যতম সোভিয়েত ইউনিয়নও কিন্তু টাল রাখতে পারেনি।
চিনের বোঝা উচিত।