সরকার রাজীব, ঢাকাঃ মার্কেট আছে, গাড়ি আছে, কিন্তু নেই পার্কিং। ফলে সড়ক দখল করে গড়ে উঠেছে গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থা। এতে বাড়ছে যানজট ও জনদুর্ভোগ। চলাচলের অনুপযোগী হয়ে উঠছে শহরের পথঘাট, অলিগলি। সৃষ্টি হচ্ছে নানা প্রতিবন্ধকতা। নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে নগরবাসীকে। রাস্তা দখল করে পার্কিংয়ের কারণে অহরহ ঘটছে দুর্ঘটনাও। রাজধানীতে পার্কিং নৈরাজ্য দীর্ঘদিনের। দিন যতই যাচ্ছে, ততই এ সমস্যা আরও প্রকট হচ্ছে।
বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্য বলছে, ঢাকায় ৩০ শতাংশ যানজটের জন্য দায়ী অবৈধ গাড়ি পার্কিং। এ জন্য প্রতিবছর অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতি হচ্ছে ১৫ হাজার কোটি টাকা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীতে অন্তত ১৫ হাজার বহুতল ভবনে নেই পার্কিং সুবিধা। ফ্ল্যাট অনুপাতে আরও লক্ষাধিক বহুতল ভবনে পর্যাপ্ত পার্কিং ব্যবস্থা নেই। ফলে ব্যস্ত সড়কের উপর অবৈধভাবে বাড়ছে গাড়ি পার্কিং। এতে রাজধানীর প্রধান প্রধান সড়কগুলো সংকুচিত হয়ে পড়েছে। এসব অবৈধ পার্কিং নগরবাসীর জীবনে বিষফোঁড়া হয়ে উঠছে। অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন ঢাকাবাসী। সরকার কার্যকরী কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় প্রতিদিনই বাড়ছে গাড়ি, কমছে সড়ক।
রাজধানীর পার্কিং নৈরাজ্য কমাতে ২০০৭ সালে অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল। তবে ২০২২ সালে এসেও তা আলোর মুখ দেখেনি। হয়নি নীতিমালাও। বিভিন্ন সময় পার্কিং নৈরাজ্য নিয়ে একাধিক সংস্থা কাজ করার কথা বললেও, সমস্যার জটিলতা কমেনি। বরং এই সময়ে পার্কিং নৈরাজ্য বেড়েছে বহুগুণ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর অধিকাংশ ভবনের নেই পার্কিং-এর ব্যবস্থা। বড় বিপণি বিতানগুলোতে পার্কিং ব্যবস্থা থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয়। এ ছাড়া সড়কের পাশেই গড়ে ওঠা মার্কেটগুলোতে রাখা হয় না পার্কিংয়ের সুবিধা। ফলে গাড়ির মালিকের ইচ্ছা ও চালকদের সুবিধার জন্য সড়ককেই বেছে নেন। ব্যস্ত ঢাকার বাণিজ্যিক এলাকা, কিংবা মার্কেটের সামনের রাস্তায় চোখে পড়ে অবৈধ গাড়ি পার্কিংয়ের দৃশ্য।
ফুটপাথ থেকে শুরু করে যেখানে সেখানে রাখা হচ্ছে এসব গাড়ি। সুবিধা মতো পার্কিংয়ের জায়গা না থাকায় যত্রতত্র গাড়ি রেখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকেন চালকরা। সড়ক দখল করে গড়ে তোলেন বাস কিংবা কার স্ট্যান্ড। সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। বিশেষ করে অফিস সময়ে অসহনীয় যানজটের ভোগান্তির শিকার হতে হয় কর্মজীবীদের।
রাজধানীর মহাখালী বানিজ্যিক এলাকা। সেখানেই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর। সংস্থাটির কার পার্কিংয়ের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। সড়কের উপরেই পার্কিংয়ের জায়গা করে নিয়েছে সরকারের এ প্রতিষ্ঠানটি। যা সড়কের তিন ভাগের দুই ভাগই দখল করে রাখে। শুধু দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর নয়। মহাখালী আমতলী থেকে গুলশান পর্যন্ত পুরো সড়কের উপর অবৈধভাবে পার্কিং করছে বিভিন্ন ব্যাংক, বীমা, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল-ক্লিনিকসহ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এতে প্রতিদিনই ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজট লেগেই থাকছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের অবৈধ পার্কিংয়ের বিষয়ে সরকারি তিতুমীর কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হক জুয়েল মোড়ল ফেসবুকে দেওয়া তার একটি পোস্টে লিখেন, ‘সরকারি রাস্তা তাই সরকারি অধিদপ্তরের গাড়ি রাস্তায় পার্কিং করার বৈধতা আছে ট্রাফিক আইনের কোন নিয়মে পরে এটা? এর আগেও বেশ কয়েকবার এটা নিয়ে লিখেছিলাম আমাদের সরকারি তিতুমীর কলেজের উল্টোদিকেই দূর্যোগ অধিদপ্তর সহ বেশ কয়েকটি অফিস তারা রাস্তার তিনভাগের দুইভাগ গাড়ি পার্কিং করে রাখে, এ কারণে আমাদের কলেজের সামনে প্রায়ই তীব্র যানজট লেগে থাকে ছাত্র-ছাত্রীদের সঠিক সময়ে ক্যাম্পাসে পৌঁছাতে পারে না অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় এমনকি পরীক্ষার্থীরা সঠিক সময়ে পরীক্ষা পর্যন্ত দিতে যেতে পারে না। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এর আমার ঢাকা apps অভিযোগ করেছি ভিডিও করে পাঠিয়েছি, ট্রাফিকের ঊর্ধ্বতন দায়িত্বপ্রাপ্ত তাদের কাছেও অভিযোগ করেছি কোন প্রতিকার নেই। এদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নিয়ে এরা অনিয়মটাকে নিয়ম করে দিলো..’
মহাখালী-গুলশান সংযোগ সড়কে সরজমিন দেখা গেছে, এখানে প্রতিটি সড়কের অলিগলিতে রাখা হয়েছে ছোট বড় গাড়ি। গোটা বাণিজ্যিক এলাকায় যানজট লেগে আছে। এই এলাকায় অধিকাংশ বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে কোনো রকম পার্কিং সুবিধা ছাড়াই। হাতেগোনা কিছু নতুন ভবনে অপর্যাপ্ত পার্কিং সুবিধা রয়েছে। আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোর তৈরি ফ্ল্যাটগুলোতে পার্কিং সুবিধা থাকলেও সেগুলোর উল্লেখযোগ্য অংশ বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। উক্ত সড়কে বর্তমানে ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন কাজ চলছে। এতে খোঁড়াখুঁড়িতে এমনিতেই সড়কের একভাগ জায়গা দখল হয়ে আছে তবুও অবৈধ পার্কিং থেমে নেই। যে কারণে ভোগান্তি পৌঁছেছে চরমে।
মহাখালী ওয়্যারলেস গেইট মোড়ে রয়েছে বেশ কয়েকটি ব্যাংক, রেস্টুরেন্ট। লাইফ-লাইন নামে একটি মেডিক্যাল সার্ভিস, কলম্বিয়া সুপার মার্কেটসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব পার্কিং ব্যবস্থা নেই। তাদের কার সড়কেই পার্কিং করা হয়। এতে গণপরিবহন চলাচলে ব্যাঘাত ঘটছে। তৈরি হচ্ছে যানজট। পথচারীদের হাঁটাচলা করতেই হিমশিম খেতে হয়। টি.বি গেইট এলাকায় ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি দখল করে রাখে মূল সড়কসহ আশে পাশের সব অলিগলি। খোঁজ খবর নিয়ে জানা যায়, তারা আশেপাশের অলিগলি পার্কিংয়ের জন্য সিটি করপোরেশন থেকে ইজারায় নিয়েছে। জনস্বার্থে ব্যাঘাত ঘটিয়ে এমন ইজারায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এলাকাবাসী।
অন্যদিকে মহাখালী আন্তজেলা বাস টার্মিনালের সামনের সড়কের দুপাশে ২ কিংবা ৩ সারিতে দাঁড় করিয়ে রাখা হয় স্বল্প ও দূরপাল্লার বাসগুলো। এতে কোথাও কোথাও সাধারণ যানবাহন, এমনকি পায়ে হেঁটে চলাচলেরও কোনো জায়গা থাকছে না। ফলে মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত লম্বা সময়জুড়ে লেগে থাকছে ভয়াবহ যানজট।
সূত্রে জানা যায়, পার্কিং নৈরাজ্য কমাতে ২০০৭ সালে মহাপরিকল্পনা হাতে নেয় সিটি করপোরেশন। সেটিকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ওই সময়ে ডিএসসিসি’র আরবান প্ল্যানিং বিভাগ একটি খসড়াও তৈরি করে। রাজধানীর পার্কিং স্পটগুলোতে কত সংখ্যক গাড়ি পার্কিং করা যায় তাও নির্ধারণ করা হয়। তখন সিদ্ধান্ত হয় নির্ধারিত স্থানে পার্কিং করবে গাড়ি। দিতে হবে টোল। টোল আদায় কর্মীদের অনুমতি ছাড়া রাস্তার পাশে কেউ গাড়ি পার্কিং করতে পারবে না। তখন আশা করা হয়, এতে গাড়ি পার্কিংয়ের ক্ষেত্রে ফিরে আসবে শৃঙ্খলা, কমে যাবে যানজট। তবে নানা জটিলতায় পার্কিং নিয়ে মহাপরিকল্পনা আটকে যায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সিটি করপোরেশন, রাজউক, ঢাকা ওয়াসা, সওজ, রেলওয়েসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো পার্কিং স্পেস বাড়াতে উচ্ছেদে নামে। সড়ক সংলগ্ন অবৈধ স্থাপনা এবং বহুতল ভবনের কার পার্কিং স্পেস অবমুক্ত করা হয়। তখন বিভিন্ন মার্কেট ও শপিং মলে পার্কিং স্পেস ছেড়ে দেন ভবন মালিকরা। অনেক মার্কেটের আন্ডারগ্রাউন্ডে বাণিজ্যিক কাজে ভাড়া দেয়া স্থাপনা ভেঙে ফেলেন। পরে সরকার পরিবর্তন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যায় সব চিত্র। ফের পার্কিং স্পেস ও আন্ডারগ্রাউন্ড বাণিজ্যিকীকরণ করা হয়।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ ফজলে রেজা সুমন একটি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমাদের দেশে পার্কিং নৈরাজ্য কমাতে কোনো গাইডলাইন নেই। ঢাকায় গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য জায়গা প্রয়োজন ২৫ শতাংশ। অথচ আছে মাত্র ৮ শতাংশ। সেটাও দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। এজন্য দ্রুত সময়ের মধ্যে মহাপরিকল্পনার বিকল্প কিছু নেই।’
ট্রাফিক বিভাগ সূত্রে জানা যায়, প্রতিদিন ঢাকার রাস্তায় নতুন করে শতাধিক যানবাহন রাস্তায় নামে। ফলে সড়কে গাড়ি পার্কিং বেড়েই চলছে। এতে যানবাহন চলাচলের গতি কমে যাচ্ছে।