1. abrajib1980@gmail.com : মো: আবুল বাশার রাজীব : মো: আবুল বাশার রাজীব
  2. abrajib1980@yahoo.com : মো: আবুল বাশার : মো: আবুল বাশার
  3. chakroborttyanup3@gmail.com : অনুপ কুমার চক্রবর্তী : অনুপ কুমার চক্রবর্তী
  4. Azharislam729@gmail.com : ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় : ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
  5. bobinrahman37@gmail.com : Bobin Rahman : Bobin Rahman
  6. farhana.boby87@icloud.com : Farhana Boby : Farhana Boby
  7. mdforhad121212@yahoo.com : মোহাম্মদ ফরহাদ : মোহাম্মদ ফরহাদ
  8. harun.cht@gmail.com : চৌধুরী হারুনুর রশীদ : চৌধুরী হারুনুর রশীদ
  9. shanto.hasan000@gmail.com : রাকিবুল হাসান শান্ত : রাকিবুল হাসান শান্ত
  10. msharifhossain3487@gmail.com : Md Sharif Hossain : Md Sharif Hossain
  11. humiraproma8@gmail.com : হুমায়রা প্রমা : হুমায়রা প্রমা
  12. dailyprottoy@gmail.com : প্রত্যয় আন্তর্জাতিক ডেস্ক : প্রত্যয় আন্তর্জাতিক ডেস্ক
  13. namou9374@gmail.com : ইকবাল হাসান : ইকবাল হাসান
  14. mohammedrizwanulislam@gmail.com : Mohammed Rizwanul Islam : Mohammed Rizwanul Islam
  15. hasanuzzamankoushik@yahoo.com : হাসানুজ্জামান কৌশিক : এ. কে. এম. হাসানুজ্জামান কৌশিক
  16. masum.shikder@icloud.com : Masum Shikder : Masum Shikder
  17. niloyrahman482@gmail.com : Rahman Rafiur : Rafiur Rahman
  18. Sabirareza@gmail.com : সাবিরা রেজা নুপুর : সাবিরা রেজা নুপুর
  19. prottoybiswas5@gmail.com : Prottoy Biswas : Prottoy Biswas
  20. rajeebs495@gmail.com : Sarkar Rajeeb : সরকার রাজীব
  21. sadik.h.emon@gmail.com : সাদিক হাসান ইমন : সাদিক হাসান ইমন
  22. safuzahid@gmail.com : Safwan Zahid : Safwan Zahid
  23. mhsamadeee@gmail.com : M.H. Samad : M.H. Samad
  24. Shazedulhossain15@gmail.com : মোহাম্মদ সাজেদুল হোছাইন টিটু : মোহাম্মদ সাজেদুল হোছাইন টিটু
  25. shikder81@gmail.com : Masum shikder : Masum Shikder
  26. showdip4@gmail.com : মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ : মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ
  27. shrabonhossain251@gmail.com : Sholaman Hossain : Sholaman Hossain
  28. tanimshikder1@gmail.com : Tanim Shikder : Tanim Shikder
  29. riyadabc@gmail.com : Muhibul Haque :
  30. Fokhrulpress@gmail.com : ফকরুল ইসলাম : ফকরুল ইসলাম
  31. uttamkumarray101@gmail.com : Uttam Kumar Ray : Uttam Kumar Ray
  32. msk.zahir16062012@gmail.com : প্রত্যয় নিউজ ডেস্ক : প্রত্যয় নিউজ ডেস্ক
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি: নাইম ইসলাম নিবির - দৈনিক প্রত্যয়

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি: নাইম ইসলাম নিবির

  • Update Time : শনিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১
  • ২১৫ Time View

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি!

— নাইম ইসলাম নিবির। 

গুলির আঘাত তেমন গুরুতর ছিল না! পটাশিয়াম সায়ানাইডের কারণেই অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন অকুতোভয় এই নারী।

পাহাড়তলী ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ শেষে পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রীতিলতা পটাসিয়াম সায়ানাইড মুখে পুরে দেন। কালীকিংকর দে’র কাছে তিনি তার রিভলবারটা দিয়ে আরো পটাশিয়াম সায়ানাইড চাইলে, কালীকিংকর তা প্রীতিলতার মুখের মধ্যে ঢেলে দেন। ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণে অংশ নেয়া অন্য বিপ্লবীদের দ্রুত স্থান ত্যাগ করার নির্দেশ দেন প্রীতিলতা। পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়া প্রীতিলতাকে বিপ্লবী শ্রদ্ধা জানিয়ে সবাই স্থান ত্যাগ করে।

পরদিন পুলিশ ক্লাব থেকে ১০০ গজ দূরে মৃতদেহ দেখে পরবর্তীতে প্রীতিলতাকে সনাক্ত করেন। তার মৃতদেহ তল্লাশীর পর বিপ্লবী লিফলেট, অপারেশনের পরিকল্পনা, রিভলবারের গুলি, রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ছবি এবং একটা হুইসেল পাওয়া যায়। এছাড়াও প্রীতিলতার নিজের হাতে লেখা এক নোট পাওয়া যায়। যাতে তার আত্মাহুতির পটভূমির বিবরণ পাওয়া যায়।

তিনি নারী জাগরণের মহান দৃষ্টান্ত। নিজের হাতের লেখা বিবৃতিতে প্রীতিলতা বলেছিলেন, ‘আমি বিধিপূর্বক ঘোষণা করিতেছি, যেই প্রতিষ্ঠানের উচ্চ আদর্শে অনুপ্রাণিত হইয়া অত্যাচারীর স্বার্থ সাধনে প্রয়োগকারী সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদ সাধন করিয়া আমরা মাতৃভূমি ভারতবর্ষে গণতান্ত্রিক শাসন প্রবর্তন করিতে ইচ্ছুক। আমি সেই ভারতীয় রিপাবলিকান আর্মির চট্টগ্রাম শাখার একজন সদস্যা।

এই বিখ্যাত ‘চট্টগ্রাম শাখা’ দেশের যুবকদের দেশপ্রেমকে নবচেতনায় উদ্বুদ্ধ করিয়াছে। স্মরণীয় ১৯৩০-এর ১৮ এপ্রিল এবং উহার পরবর্তী পবিত্র জালালাবাদ ও পরে কালারপুল, ধলঘাটসহ বিভিন্নস্থানে বিরোচিত কার্যসমূহ ভারতীয় মুক্তিকামী বিদ্রোহীদের মনে এক নতুন প্রেরণা জাগাইয়া তুলিয়াছে। আমি এইরূপ গৌরবমণ্ডিত একটি সংঘের সদস্যা হইতে পারিয়া রিজেকে সৌভাগ্যবতী অনুভব করিতেছি।

আমরা দেশের মুক্তির জন্যই এই সশস্ত্র যুদ্ধ করিতেছি। অদ্যকার পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ স্বাধীনতা যুদ্ধেরই একটি অংশ। আমাদের দলের মহামান্য ও পূজনীয় নেতা মাস্টারদা অদ্যকার এই সশস্ত্র অভিযানে যোগ দিবার জন্য যখন আমাকে ডাক দিলেন, তখন আমি নিজেকে যথেষ্ট সৌভাগ্যবতী মনে করিয়াছিলাম। মনে হইল, এতদিনে আমার বহু প্রত্যাশিত অভীষ্ট সিদ্ধ হইল এবং সম্পূর্ণ দায়িত্ব লইয়া আমি এই কর্তব্যভার গ্রহণ করিলাম।

এই উন্নত ব্যক্তিত্ববিশিষ্ট নেতৃত্ব যখন আমার মতো একটি মেয়েকে এই গুরুভার অর্পণ করেন তখন এতগুলি কর্মঠ ও যোগ্যতর ভাইয়েরা বর্তমান থাকিতে অভিযানে নেতৃত্বের ব্যাপার একজন ভগিনীর ওপর কেন ন্যস্ত হইবে, এই বলিয়া আমি আপত্তি জানাইলাম এবং একজন সাধারণ কর্মী হিসেবে ওই কাজে যাইতে চাহিলাম। আমি পূজ্য নেতার আদেশ শিরোধার্য করিয়া লইলাম।

দেশের মুক্তি সংগ্রামে নারী ও পুরুষের পার্থক্য আমাকে ব্যথিত করিয়াছিল। যদি আমাদের ভাইয়েরা মাতৃভূমির জন্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হইতে পারে, আমরা ভগিনীরা কেন উহা পারিব না? নারীরা আজ কঠোর সংকল্প নিয়াছে যে তাহারা আজ পশ্চাতে পড়িয়া থাকিবে না। নিজ মাতৃভূমির মুক্তির জন্য যে কোনো দুরূহ বা ভয়াবহ ব্যাপারে ভাইদের পাশাপাশি দাঁড়াইয়া সংগ্রাম করিতে তাহারা ইচ্ছুক- ইহা প্রমাণ করিবার জন্যই আজিকার এই অভিযানের নেতৃত্ব আমি গ্রহণ করিতেছি।

আমি ঐকান্তিকভাবে আশা করি যে, আমার দেশের ভগিনীরা আজ নিজেকে দুর্বল মনে করিবেন না। সশস্ত্র ভারতীয় নারী সহস্র বিপদ ও বাধাকে চূর্ণ করিয়া এই বিদ্রোহ ও সশস্ত্র মুক্তি আন্দোলনে যোগদান করিবেন এবং তাহার জন্য নিজেকে তৈয়ার করিবেন- এই আশা লইয়াই আমি আজ এই আত্মদানে অগ্রসর হইলাম।’

তিনি ভারতের মুক্তিসংগ্রামে অগ্নিযুগের প্রথম নারী শহীদ। ব্রিটিশভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামীর ডাক নাম ছিল রাণী। আদর করে তার মা তাকে এই নামে ডাকতেন। তার  ছদ্মনাম ফুলতার। ১৯১১ সালের ৫ই মে মঙ্গলবার চট্টগ্রামের ধলঘাট গ্রামে মামা বাড়িতে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের জন্ম। তার পিতা জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার ছিলেন চট্টগ্রাম পৌরসভার হেড ক্লার্ক। মায়ের নাম প্রতিভাদেবী ছিলেন পুরোদস্তুর গৃহিণী। ছয় ভাইবোনের মধ্যে প্রীতির অবস্থান দ্বিতীয়। তার অন্য ভাইবোনরা হলেন মধুসূদন, কনকলতা, শান্তিলতা, আশালতা ও সন্তোষ।

তাদের পরিবারের আদি পদবী ছিল দাশগুপ্ত। পরিবারের কোন এক পূর্বপুরুষ নবাবী আমলে ওয়াহেদেদার উপাধি পেয়েছিলেন, এই ওয়াহেদেদার থেকে ওয়াদ্দেদার বা ওয়াদ্দার। শৈশবে পিতার মৃত্যুর পর জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার তার পৈত্রিক বাড়ি ডেঙ্গাপাড়া সপরিবারে ত্যাগ করেন।পরবর্তীকালে চট্টগ্রাম শহরের আসকার খানের দীঘির দক্ষিণ-পশ্চিম পাড়ে স্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করে ওয়াদ্দেদার পরিবার। টিনের ছাউনি দেয়া মাটির একটা দোতলা বাড়িতে ছিল তাদের বসবাস।

১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে ডাঃ খাস্তগীর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শুরু করেন। প্রতি ক্লাসে ভালো ফলাফলের জন্য তিনি সব শিক্ষকের খুব প্রিয় ছিলেন। সেই শিক্ষকের একজন ছিলেন ইতিহাসের ঊষাদি। তিনি প্রীতিলতাকে পুরুষের বেশে ঝাঁসীর রানি লক্ষীবাই এর ইংরেজ সৈন্যদের সঙ্গে লড়াইয়ের ইতিহাস বলতেন। সেই সময়ে ঝাঁসীর রানি প্রীতির চেতনাকে উদ্দীপ্ত করে। নিজেকে অকুতোভয় বিপ্লবী হিসাবে দেখা শুরু করেন তিনি।

১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে বেঙ্গল অর্ডিনান্স নামে এক জরুরি আইনে বিপ্লবীদের বিনা বিচারে আটক করা শুরু হয়। এই সময় চট্টগ্রামের বিপ্লবীদলের বহু নেতা-কর্মী এই আইনে আটক হয়েছিল। সে সময় প্রীতিলতার নিকট-আত্মীয় পূর্ণেন্দু দস্তিদার বিপ্লবী দলের কর্মী ছিলেন। তিনি সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত কিছু গোপন বই প্রীতিলতার কাছে রাখেন। তখন  দেশের কথা, বাঘা যতীন, ক্ষুদিরাম আর কানাইলাল ইত্যাদি রচনা তিনি লুকিয়ে পড়তে থাকেন। মূলত এই সমস্ত বই পড়ে তিনি বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত হন।

এই স্কুল থেকে থেকে ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। কয়েকটি বিষয়ে লেটার মার্কস পেয়ে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। অঙ্কের নম্বর খারাপ ছিল বলে তিনি বৃত্তি পেলেন না। ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর বন্ধের সময় তিনি নাটক লিখেন এবং মেয়েরা সবাই মিলে সে নাটক চৌকি দিয়ে তৈরি মঞ্চে পরিবেশন করেন। এরপর তিনি ঢাকা ইডেন মহিলা কলেজে ভর্তি হন। এ কলেজের ছাত্রী নিবাসের মাসিক থাকা খাওয়ার খরচ ছিল ১০ টাকা এবং এর মধ্যে কলেজের বেতন ও হয়ে যেত।

এ কারণেই অল্প বেতনের চাকুরে জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার মেয়েকে আইএ পড়তে ঢাকায় পাঠান। ১৯৩০ সালে আইএ পরীক্ষায় তিনি মেয়েদের মধ্যে প্রথম এবং সবার মধ্যে পঞ্চম স্থান লাভ করে। এই ফলাফলের জন্য তিনি মাসিক ২০ টাকার বৃত্তি পান। ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে চট্টগ্রামে সূর্যসেন ও তার সহযোগীরা চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেসের জেলা সম্মেলন, ছাত্র সম্মেলন, যুব সম্মেলন ইত্যাদি আয়োজনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এই পরিকল্পনায় নারী সম্মেলন ছিল না। তবে পূর্ণেন্দু দস্তিদারের বিপুল উৎসাহের জন্যই সূর্য সেন নারী সম্মেলন আয়োজনের সম্মতি দেন।

নারী কংগ্রেস নেত্রী লতিকা বোসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানটি পরিচালিত হয়। এই সম্মেলনে প্রীতিলতা ঢাকা থেকে এবং তার বন্ধু ও সহযোদ্ধা কল্পনা দত্ত কলকাতা থেকে এসে যোগদান করেন। তাদের দুজনের আপ্রাণ চেষ্টা ছিল সূর্য সেনের অধীনে চট্টগ্রামের বিপ্লবী দলে যুক্ত হওয়া। তবে শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়ে তাদের ফিরে যেতে হয়। পরে অবশ্য পূর্ণেন্দু দস্তিদারের চেষ্টায় সূর্যসেন কল্পনা দত্ত ও তাকে দলভুক্ত করেন।

১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই এপ্রিল, মোট ৬৫ জন যোদ্ধা নিয়ে সূর্যসেন রাত দশটার চট্টগ্রাম পুলিশ লাইনে আক্রমণ করে। আক্রমণ শেষে ১৯শে এপ্রিল এরা সারাদিন সুলুক পাহাড়ে আশ্রয় নেন। এরপর ফতেয়াবাদে কিছুটা সময় কাটিয়ে, সূর্যসেন সবাইকে নিয়ে জালালাবাদ পাহাড়ে আশ্রয় নেন। ঠিক এই দিনই প্রীতিলতা আইএ পরীক্ষা দিয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ফিরে আসেন।

প্রীতিলতার একটি লেখা থেকে জানা যায়- ‘পরীক্ষার পর ওই বছরেরই ১৯ শে এপ্রিল সকালে বাড়ি ফিরে আমি আগের রাতে চট্টগ্রামের বীর যোদ্ধাদের মহান কার্যকলাপের সংবাদ পাই। ওই সব বীরদের জন্য আমার হৃদয় গভীর শ্রদ্ধায় আপ্লুত হলো। কিন্তু ওই বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে না পেরে এবং নাম শোনার পর থেকেই যে মাষ্টারদাকে গভীর শ্রদ্ধা করেছি তাকে একটু দেখতে না পেয়ে আমি বেদনাহত হলাম’।

এরপর তিনি কলকাতার বেথুন কলেজ ভর্তি হন এবং ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে এই কলেজ থেকে দর্শনশাস্ত্রে ডিস্টিংশনসহ গ্রাজুয়েশন করেন। কবে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকায় কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতক পাস করলেও তিনি এবং তার সঙ্গী বীণা দাসগুপ্তের পরীক্ষার ফল স্থগিত রাখা হয়। অবশেষে তাদেরকে ২২ মার্চ, ২০১২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে মরণোত্তর স্নাতক ডিগ্রী প্রদান করা হয়।

১৩৩২ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ই জুন পটিয়ার ধলঘাটে সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে গোপন বৈঠকের জন্য সূর্যসেন, নির্মল সেন, প্রীতিলতা ও অপূর্ব সেন মিলিত হন। সেখানে হঠাৎ গুর্খা সৈন্য নিয়ে হানা দেয় ক্যাপ্টেন ক্যামেরন। এখানকার যুদ্ধে ক্যাপ্টেন ক্যামেরন নিহত হয়। বিপ্লবীদের পক্ষে শহিদ হয়েছিলেন নির্মল সেন। পরে পালিয়ে যাওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হন অপূর্ব সেন (ভোলা)।

প্রীতিলতার ডায়েরি থেকে জানা যায়, এই সময় অপূর্ব সেন জ্বরে কাতর ছিলেন। দোতলার একটি ঘরে প্রীতিলতা, অপূর্ব সেন ও নির্মল সেন ছিলেন। সৈন্যদের আগমনের কথা সূর্য সেন এসে সবাইকে জানান। সূর্য  সেন প্রীতিলতাকে নিচের তলার মেয়েদের ভিতর পাঠিয়ে দেন। আক্রমণের শুরুতেই ক্যামেরন নির্মল সেনের গুলিতে নিহত হয়। এরপর আরো কিছুক্ষণ উভয় পক্ষের ভিতর গুলি চলে। এক পর্যায়ে নির্মল সেন মৃত্যুবরণ করেন।

পরে প্রীতিলতা ও অপূর্ব সেনকে নিয়ে সূর্য সেন সন্তর্পণে এই বাড়ি ত্যাগ করেন। পালানোর সময় সৈন্যদের গুলিতে অপূর্ব সেন মৃত্যবরণ করেন। জুলাই মাসে সরকার সূর্য সেনকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য ১০ হাজার টাকা পুরষ্কার ঘোষণা করে। তৎকালীন আনন্দবাজার পত্রিকায় এই বিষয়ে একটি খবর প্রকাশিত হয়। এর ১০ দিন পর অর্থাৎ আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘চট্টগ্রামের পলাতকা’ নামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়।

সেখানে লেখে ছিল, চট্টগ্রাম জিলার পটিয়া থানার ধলগ্রামের শ্রীমতী প্রীতিলতা ওয়াদ্দাদার গত ৫ই জুলাই, মঙ্গলবার চট্টগ্রাম শহর হইতে অন্তর্ধান করিয়াছেন। তাহার বয়স ১৯ বৎসর। পুলিশ তাঁহার সন্ধানের জন্য ব্যস্ত। এই সময় সূর্যসেন তাকে এবং কল্পনা দত্ত নামক অপর বিপ্লবীকে আত্মগোপনের নির্দেশ দেন। পলাতক অবস্থায় তিনি সূর্যসেনের নির্দেশে ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের ২৪শে সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে অবস্থিত ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করেন। এই দলে তিনি ছাড়া সবাই পুরুষ বিপ্লবী ছিলেন।

একমাত্র নারী হিসেবে পুরো অপারেশনের নেতৃত্ব দেন প্রীতিলতা। এর আগে ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৩২ সালে পাহাড়তলীতে ব্রিটিশ সৈন্যের হাতে ধরা পড়েন কল্পনা দত্ত। এরপর পুরো দায়িত্ব এসে পড়ে প্রীতিলতার উপর।  প্রীতিলতা এতে খুবই আনন্দিত হন। কাট্টলী সমুদ্র সৈকতে গিয়ে বোমা ছোড়া ও গুলিতে লক্ষ্য স্থির করার শিক্ষাগ্রহণ করতে শুরু করেন তিনি। নির্ধারিত দিনে মাস্টারদা একজন দেহরক্ষী নিয়ে আবার ওখানে রাত পৌনে ১০টায় হাজির হন।

ক্লাব আক্রমণের জন্য প্রীতিলতার নেতৃত্বে অন্য যেসব বিপ্লবী নির্বাচিত হয়েছিলেন তারা হলেন- শান্তি চক্রবর্তী, কালীকিঙ্কর দে, সুশীল দে, প্রফুল দাস, পান্না সেন, বীরেশ্বর রায়, মহেন্দ্র চৌধুরী। রাত ১০টায় পূর্ণ সামরিক বেশে সজ্জিত হয়ে প্রীতিলতা ও অন্য বিপ্লবীরা সর্বাধিনায়কের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ক্লাব আক্রমণের জন্য বেরিয়ে যান। আগে থেকে ক্লাবের সম্পর্কে পূর্ণেন্দু দস্তিদারের মাধ্যমে ক্লাবের বাবুর্চি মনসুর আহমদের কাছ থেকে পূর্ণ তথ্য বিপ্লবীরা জোগাড় করেছিলেন।

প্রীতিলতা বিপ্লবীদের নিয়ে ক্লাবের কাছাকাছি বেশ নিরাপদেই চলে আসেন। সেখানে গিয়ে একটু ঝোপের মতো জায়গায় কিছুক্ষণ তারা আত্মগোপন করে থাকেন। সেখান থেকে তারা দেখতে পান যে ক্লাবে তখন বল নাচ চলছে এবং সশস্ত্র প্রহরী দরজায় দাঁড়ানো। তবুও বিপ্লবীরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে, তাঁরা আক্রমণ করবেনই। আক্রমণ পদ্ধতি সম্পর্কে গোপন-ঘাঁটি ত্যাগ করার পূর্বেই বিশদ আলোচনা হয়েছে। তবুও আরেকবার প্রীতিলতা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেন, হুইসেল দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে যুগপৎ তিন দিক থেকে আক্রমণ করতে হবে।

বিলিয়ার্ড রুমের দিকে একদল, পিছন দিক থেকে একদল এবং প্রীতিলতার সঙ্গে একদল। প্রথমে বোমা, রাইফেল ও রিভলবার দিয়ে আক্রমণ চালাতে হবে। ক্লাবের মনসুর আহমদ নামক কাট্টলী গ্রামস্থ একজন মুসলিম বাবুর্চির সঙ্গে আগে থেকে বিপ্লবীদের সংযোগ হয়েছিল। এই মুসলিম যুবক বিপ্লবীদের ক্লাব সম্পর্কে সব তথ্য সরবরাহ করেছিল।ক্লাবে ইউরোপীয়ান নারী-পুরুষ কখন বিশেষভাবে নাচে মত্ত থাকবেন সেই সুযোগের অপেক্ষা। এই ক্ষণটিতে বাবুর্চিখানার ছোট জানালা থেকে বাবুর্চি মনসুর একটি ছোট টর্চের আলো কয়েকবার জ্বালানো ও নিভানো দ্বারা সংকেত করবেন তা আগে থেকেই স্থির ছিল। দেখা গেল, মনসুর ঠিকমতো এই সংকেত পাঠাচ্ছেন।

প্রীতিলতা তখনই ক্লাব আক্রমণের আদেশ দিয়ে নিজেও দৌড়ে সামনের দরজায় গিয়ে বোমা নিক্ষেপ করেন। দরজায় যে সশস্ত্র প্রহরী ছিল তাদের মধ্যে কেউ আহত হয়েছে, আবার কেউ পলায়ন করে আত্মরক্ষা করে। অন্য দুদিক থেকেও আক্রমণ শুরু হয়। আর্তনাদ, হাহাকার, ধোঁয়া সবকিছু মিলে এক ভয়ঙ্কর অবস্থার সৃষ্টি হয়। এক ইংরেজ ওই সময় মদের টেবিল থেকে বোতল, কাচের গ্লাস এসব বিপ্লবীর দিকে ছুড়ে মারছিল। প্রীতির অব্যর্থ গুলিতে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।

টেবিলের তলা থেকে এক ইংরেজ হঠাৎ প্রীতিকে লক্ষ্য করে গুলি করে। গুলি প্রীতিলতার হাতে লেগে বুকের পাশ দিয়ে চলে যায়। প্রীতিও ইংরেজকে গুলি করে। প্রীতিলতার ক্ষতস্থান থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হতে থাকে। দূর থেকে মিলিটারি মোটরগাড়ির সন্ধানী আলো এসে ক্লাবের দিকে পড়তেই প্রীতির আদেশে বিপ্লবীরা পশ্চাৎপসরণ করে। কিছু দূর এগিয়ে যাবার পরই প্রীতিলতা জিজ্ঞেস করেন সবাই ঠিকমতো এসেছে কি-না। দেখা গেল সবাই ফিরে এসেছেন, যখন প্রীতিলতার গতি শ্লথ হয়ে পড়ে, তখন ঘড়ির কাঁটা রাত ১২টা অতিক্রম করে ২৪ সেপ্টেম্বরে প্রবেশ করেছে।

তখনই পোশাকের ভিতর থেকে তিনি বের করেন মারাত্মক বিষ পটাসিয়াম সায়েনাইড। স্বাদে মিষ্ট এই বিষ প্রীতিলতা তখন মুখে ঢেলে দেন। আহত হয়ে যদি পড়ে থাকতে হয় তাহলে কোনো ঘৃণ্য দৈহিক অত্যাচার থেকে রেহাই পেতেই বিষপান করেন তিনি। প্রীতিলতার আঘাতের স্থান থেকে রক্তক্ষরণে তার গায়ের পোশাক ভিজে যাচ্ছিল, তা থেকে প্রীতিলতা হয়তো মনে করেছিলেন, তার আঘাত বেশ গুরুতর। আর ওই অবস্থায় শত্রুর হাতে যাওয়া অপেক্ষা নিজেকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্যই প্রীতিলতা সায়েনাইড খেয়েছিলেন।

মাত্র একুশ বছর বয়সে দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করে প্রীতিলতা বীর নারীর অমরত্ব লাভ করেন। আক্রমণের কিছুক্ষণ পর পুলিশ ও মিলিটারি এসে মৃত ও আহত ইংরেজ নর-নারীদের ক্লাবের ভিতর থেকে বারান্দায় এনে পাশাপাশি রাখে। একটু পরেই অনতিদূরে খাকি পোশাক পরিহিত আরেক মৃতদেহও আবিষ্কার করে। পরে শরীর অনুসন্ধান করতে গিয়ে তারা বুঝতে পারে এই মৃতদেহটি বিপ্লবীর, সঙ্গে সঙ্গে মৃতদেহটি কোতোয়ালি থানায় পাঠিয়ে দেয়। মৃতদেহ তল্লাশি করতে গিয়ে মাথার পাগড়ি খোলার সঙ্গে সঙ্গেই দীর্ঘ কেশ মাটিতে এলিয়ে পড়ে।

এভাবেই ২৪শে সেপ্টেম্বর, ১৯৩২ সালে মাত্র ২১ বছর, ৪ মাস ১৯ দিন বয়সে তিনি শহীদ হন। তার মৃত্যুর পর তার বাবা শোকে দুঃখে পাগলের মত হয়ে গেলেন, কিন্তু প্রীতির মা গর্ব করে বলতেন, আমার মেয়ে দেশের কাজে প্রাণ দিয়েছে। তাদের দুঃখের পরিসীমা ছিল না, তবু তিনি সে দুঃখেকে দুঃখ মনে করেননি। ধাত্রীর কাজ নিয়ে তিনি সংসার চালিয়ে নিয়েছেন। প্রীতিলতার বাবা মেয়ের দুঃখ কোনোদিনও ভুলতে পারেননি। আজ এই বিপ্লবী নারীর ৮৯ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে। তার প্রতি রইল গভীর শ্রদ্ধা।

নাইম ইসলাম নিবির : রাজনীতিক ও কলামিস্ট

nayemulislamnayem148@gmail.com

Please Share This Post in Your Social Media

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ দেখুন..