নিজস্ব প্রতিবেদকঃ রাজধানীর মহাখালী সাততলা বস্তি একাধিকবার উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়েও পিছু হটেছে সরকার। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা বস্তিবাসীর পক্ষে। বস্তি উচ্ছেদে সরকার উদ্যোগ নিতে গেলে সবাই একসঙ্গে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। উচ্চ আদালতে মামলা করে বছরের পর বছর ধরে বস্তি উচ্ছেদ কার্যক্রম স্থগিত করে রাখা হয়েছে। এসব কারণে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মাণের উদ্যোগ সফল হচ্ছে না।
২০১৬ সালে সাততলা বস্তি উচ্ছেদ করে সেখানে ‘স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স’ নির্মাণ করতে চায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী, তৎকালীন র্যাবের মহাপরিচালক, ডিএমপি কমিশনারসহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম দফায় দফায় বৈঠক করেছেন। বস্তি উচ্ছেদে কয়েক দফা উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। সেসময় তৎকালীন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আনিসুল হক বস্তিবাসীর পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি সাততলা বস্তিকে ‘আদর্শ নগর’ নামকরণ করেছেন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বেহাত হওয়া জায়গা উদ্ধারের পর সেখানে অটিস্টিক একাডেমি ভবন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বাংলাদেশ কার্যালয়, বাংলাদেশ ব্রেস্টফিডিং ফাউন্ডেশন, জাতীয় ব্লাড সেন্টার ভবন, সেবা পরিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ইপিআই ভবন ও সেন্টার ফর মেডিকেল বায়োটেকনোলজি ভবন নির্মাণ করতে চায় সরকার।
জানা গেছে, প্রথম ২০০৩ সালে সাততলা বস্তি উচ্ছেদের নোটিশ জারি করেছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ওই নোটিশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বস্তিবাসীর পক্ষে ওমর ফারুক নামে এক ব্যক্তি হাইকোর্টে রিট করেন। রিটের শুনানি শেষে বস্তি উচ্ছেদ-সংক্রান্ত নোটিশের কার্যকারিতা স্থগিত করেন হাইকোর্ট। এরপর ২০১০ সালে আরেক দফা বস্তি উচ্ছেদের চেষ্টা চালালেও আদালতের রায়ে অবশেষে তাও স্থগিত হয়ে যায়।
প্রয়াত সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ২০১৪ সালের ১৩ নভেম্বর সাততলা বস্তি উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বস্তি উচ্ছেদের পর ওই জমিতে সাতটি প্রতিষ্ঠানসহ ‘স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স’ গড়ে তোলার পরিকল্পনাও নেওয়া হয়। মহাখালীতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বেহাত হয়ে যাওয়া ৫০ একর জমি উচ্ছেদে ২০১৬ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় কমিটি গঠন করে সরকার। ওই কমিটিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পূর্ত মন্ত্রণালয়, র্যাব, ঢাকা মহানগর পুলিশ, জেলা প্রশাসন ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিনিধিদের রাখা হয়। তখন সভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ৭ মার্চ ২০১৬ মধ্যে বস্তি উচ্ছেদের প্রস্তাব দেন। সভায় উপস্থিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, র্যাবপ্রধান, ডিএমপিসহ সংশ্লিষ্টরা এতো অল্প সময়ের মধ্যে সাততলা বস্তি উচ্ছেদ অসম্ভব বলে মত দিয়েছিলেন। সেই কমিটি গঠনের পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো বস্তি উচ্ছেদ অসম্ভবই রয়ে গেছে।
সর্বশেষ কয়েকদিন আগে সাততলা বস্তি উচ্ছেদ করতে বস্তিতে বসবাসরত সকল বাসিন্দাকে এক সপ্তাহের মধ্যে জায়গা খালি করে অন্যত্র চলে যাওয়ার নোটিশ দেয় বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদ (বিএমআরসি) কর্তৃপক্ষ। প্রায় ১০ একর জায়গা সীমানা নির্ধারণ করে লাল পতাকা টাঙিয়ে দেয় তারা।
নোটিশ দেওয়ার পরের দিন গত ১৯ সেপ্টেম্বর সকালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ বস্তি উচ্ছেদ করতে গেলে বাঁধার মুখে পড়ে। পরে বস্তি উচ্ছেদের প্রতিবাদে মহাখালীতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে সাততলা বস্তির বাসিন্দারা। পুনর্বাসন ছাড়া উচ্ছেদ তারা মেনে নেবেন না উল্লেখ করে বিভিন্ন স্লোগান দেন। বস্তি সংক্রান্ত একটি মামলা এখনো বিচারাধীন বলে জানান তারা। এসময় অবরোধের কারণে মহাখালীতে যান চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। প্রায় দুই ঘণ্টা পর স্থানীয় জনপ্রতিনিধি মোহাম্মদ নাছিরের আশ্বাসে অবরোধ তুলে নেয় বস্তিবাসী। মোহাম্মদ নাছির বলেন, ‘বস্তিবাসীর পক্ষ থেকে তিনটি প্রস্তাব বিএমআরসি কর্তৃপক্ষকে দিয়েছি। এই প্রস্তাব তারা মেনে নিলে বস্তিবাসী হাসি মুখে জায়গা ছেড়ে দিবে।’ তিনি বলেন, হাসপাতাল করার জন্য তারা অল্প জায়গা নেক। একটা হাসপাতাল করতে তারা পুরো এলাকা বাউন্ডারি দিবে তা তো মেনে নেয়া যায় না।’
সরেজমিন ঘুরে ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মহাখালীতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের ৪৭ দশমিক ৮৮ একর এবং সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে ৩৫ একর জমি রয়েছে। সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের ৮ একর জমি দখল করে সাততলা বস্তি গড়ে উঠেছে। এই সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের দুই পাশ ঘিরে সাততলা বস্তির অবস্থান। সাততলা বস্তিতে প্রায় ৩০ হাজার ছিন্নমূল মানুষ বসবাস করে। ছোট ছোট টিনের ছাউনি দিয়ে অন্তত ১০ হাজারেরও বেশি ঘরবাড়ি তোলা হয়েছে। এসব ঘর থেকে প্রতি মাসে গড়ে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা করে ভাড়া আদায় করা হয়। বস্তি ঘিরে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, প্রভাবশালী ব্যক্তি ও সন্ত্রাসীরা অবৈধ ব্যবসার জাল ছড়িয়ে রেখেছে। ক্ষমতার পরিবর্তন হলে বস্তি নিয়ন্ত্রকদের পরিচয়ও পাল্টে যায়।
স্থানীয় সচেতন মহলের মানুষ বলেছে, এই বস্তি তো রাতারাতি গড়ে উঠেনি। আর গোপনেও হয়নি। শুরুতেই কেন বাধা দেওয়া হলো না। বছরের পর বছর ধরে বস্তির আয়তন বেড়েছে। যখন যারা ক্ষমতায় ছিল বস্তির মানুষের মাধ্যমে মুনাফা ভোগ করেছে তারা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কিছু লোকেরাও বস্তি নিয়ন্ত্রণের সাথে জড়িত। লাখ লাখ টাকা চাঁদার বিনিময়ে বস্তিতে ঘর তোলার অনুমতি দিয়েছে ক্ষমতাশালীরা, অবৈধ ব্যবসার নিয়ন্ত্রকও তারা। মূলত সাততলা বস্তি উচ্ছেদে বড় বাঁধা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। তারাই চান না বস্তি উচ্ছেদ হোক।